সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সমকালীন অন্যান্য সভ্যতার সম্পর্ক

সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সমকালীন অন্যান্য সভ্যতার সম্পর্ক : সিন্ধু সভ্যতার সমকালীন কিংবা কিছু পূর্বের সুমেরীয়, মিশরীয় সভ্যতার সম্পর্ক আলোচিত হলো।

সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সমকালীন অন্যান্য সভ্যতার সম্পর্ক, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে মিশরীয়-সুমেরীয়-মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সম্পর্ক

ভূমিকা

সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ কেমন করে ঘটল তা নির্ধারণ করা কঠিন। বালুচিস্তান ও রাজস্থানে প্রাক্-সিন্ধু সভ্যতার বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতা হয়ত এগুলিরই পরিণত রূপ। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক কি ছিল তা স্পষ্ট নয়। খ্রীঃ পূঃ তৃতীয় সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে সিন্ধুর পাশাপাশি নীল নদ ও ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস উপত্যকাতেও যথাক্রমে মিশরীয় এবং সুমেরীয় ও মেসোপটেমিয় সভ্যতারও উন্মেষ ঘটে। তিনটি সভ্যতার স্বতন্ত্র ধারা থাকলেও পণ্ডিতরা ধরে নেন যে এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও ছিল। কিন্তু কোন সভ্যতা কাকে প্রভাবিত করেছে বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষপর্বে পশ্চিম এশিয় সভ্যতাগুলির অবদান কতখানি, এ প্রশ্নে কোন সিদ্ধান্তে আসা কঠিন।

সিন্ধু, মিশরীয় এবং সুমেরীয়-মেসোপটেমিয় সভ্যতার সাদৃশ্য

উল্লিখিত তিন সভ্যতার সাদৃশ্যগুলি লক্ষণীয়।

[ক] সবগুলিই নদীমাতৃক, তাম্রপ্রস্তরযুগের, সবগুলিরই নগরবিন্যাস, গৃহনির্মাণ রীতি, পৌরসচেতনতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চরিত্র এক ধরনের। [খ] সুমেরীয়দের মত সিন্ধুর অধিবাসীগণও মাতৃদেবীর আরাধনা করত। [গ] উভয়েই কুমোরের চাকা ব্যবহার করত ও লিপির ব্যবহার জানত। [ঘ] পোড়া মাটির ইটের ব্যবহার ও পয়ঃপ্রণালী নির্মাণের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য আছে।

এই সাদৃশ্যগুলির ভিত্তিতেই কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন যে পশ্চিম এশিয় প্রভাবেই সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব। সিন্ধু সভ্যতা ফলে দেখা গেছে মহেঞ্জোদড়োর নিম্নতম স্তরের সভ্যতাও ছিল পরিণত মানের। সিদ্ধ উপত্যকার নগরগুলির উঁচু এলাকা, দুর্গ ও প্রাকারের আবিষ্কার যেন বিদেশীদের বাসস্থানের ইঙ্গিত দেয়। এও বলা হয় যে মূলত বিদেশী উৎসের হওয়ায় সিন্ধু সভ্যতা ভারতের অভ্যন্তরে বেশি দূর প্রবেশ করতে পারেনি।

বাণিজ্যিক যোগাযোগ

উপরোক্ত দাবির সমর্থনে প্রশ্নাতীত সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করা কঠিন। তবে সুমেরীয়, মেসোপটেমিয় ও স্বল্প পরিমাণে হলেও মিশরীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার যোগাযোগ যে ছিল তা প্রমাণিত। সিন্ধুর সীলমোহর মেসোপটেমিয়ার উর ও সংলগ্ন স্থানে পাওয়া গেছে। সিন্ধুর সূতীবস্ত্র পশ্চিম এশিয়ায় রপ্তানি হত। সুমেরীয় লিপিতে উল্লেখিত ‘মেলুকা’কে সিন্ধু-অঞ্চল বলে মনে করা হয়। মূল্যবান পাথর ও প্রসাধন সামগ্রী মেসোপটেমিয়া থেকে সিন্ধু অঞ্চলে আমদানি হত। কিছু মিশরীয় দ্রব্য সুমেরীয় মধ্যস্থদের মাধ্যমে সিন্ধু উপত্যকায় পৌঁছতো। গুজরাতের লোখালে সিন্ধু সভ্যতার সময়কার বন্দর আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রত্নতত্ত্ববিদগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে এই আদান-প্রদান প্রধানত সমুদ্রপথেই সংঘটিত হত।

সিন্ধু, মিশরীয় এবং সুমেরীয়-মেসোপটেমিয় সভ্যতার বৈসাদৃশ্য

মিশরীয়, সুমেরীয়-মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধু, তিনটি সভ্যতাই সমসাময়িক হওয়ায় এদের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন থাকা স্বাভাবিক। এর ফলে একে অপরকে প্রভাবিত করাও অসম্ভব নয়। কিন্তু পশ্চিম এশিয় সভ্যতাগুলির সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যগুলিই বেশি লক্ষণীয়।

[ক] সুমেরীয় ও সিন্ধু সীলগুলির আকৃতি এক রকম ছিল না। [খ] সিন্ধু সভ্যতার গৃহনির্মাণে যে ব্যাপকহারে পোড়ামাটির ইট ব্যবহৃত হয়েছে সুমেরে তা হয়নি। উভয় সভ্যতার ইটের আকৃতিতে অমিল রয়েছে। [গ] মৃৎশিল্পের প্রকৃতিতে পার্থক্য দেখা যায়। উভয়ের স্থাপত্য শৈলীতে মিল নেই। [ঘ] মৃতদেহ সমাধিস্থ করার রীতির মধ্যে উভয়ের পার্থক্য ছিল। [ঙ] সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হলেও সেগুলি চিত্রলিপি যা চরিত্রের দিক থেকে সুমেরীয় লিপির থেকে ভিন্ন।

বলা যেতে পারে তিনটি সংস্কৃতি মোটামুটি সমকালীন ও এদের মধ্যে স্থল ও নৌপথে যোগাযোগ থাকায় এদের বিকাশের ধারার মধ্যে কিছু সাদৃশা থাকা স্বাভাবিক। সেই কারণেই কতকগুলি মৌলিক ক্ষেত্রে কিছু মিল দেখা যায়, যেমন- নগরজীবন, খাদ্যশস্য উৎপাদন, বন্যপশুকে পোষ মানানো, বয়ন ও ধাতু শিল্প, মৃৎপাত্র ও ইট নির্মাণ, মূল্যবান পাথর সম্পর্কে আগ্রহ। ফলে কোন সভ্যতা কাকে প্রভাবিত করেছে বা আদৌ করেছে কিনা, এ প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়।

সিন্ধু সভ্যতার বিশেষত্ব

মর্টিমার হুইলার মনে করেন সিন্ধু সভ্যতা সুমেরীয় সভ্যতার কাছে ঋণী। গর্ডন চাইল্ড বলেছেন সিন্ধু সভ্যতা সুমেরীয় সভ্যতাকে অনুকরণ করেনি। জন মার্শাল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সুমেরীয় ও মিশরীয় সভ্যতাসহ সমকালীন বিশ্বের যে-কোন সভ্যতার চেয়ে সিন্ধু সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, মহেঞ্জোদড়োর বিশাল মানাগার, প্রাচীর, স্নানঘর ও জলনিকাশের বিশদ ব্যবস্থাসহ বসতবাড়িগুলি প্রমাণ করে, সাধারণ নগরবাসী কি পরিমাণ স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতা ভোগ করত যা অন্য সভ্য জগতে দেখা যায় না। সিন্ধু সভ্যতা ছিল অখণ্ড ও তার স্বাতন্ত্র্যও অনস্বীকার্য। অন্য সভ্যতার প্রভাব পড়লেও সে ছিল তার স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।


সিন্ধু সভ্যতা থেকে অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর

error: Content is protected !!