সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতার তুলনামূলক আলোচনা করা হলো।
সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য
সূচনা
সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার সম্পর্ক প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের একট বিতর্কিত বিষয়। ১৯২১-২২ খ্রীঃ-এ সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত বৈদিক সভ্যতাকেই ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা বলে মনে করা হত। এখনও কোন কেম ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে আর্যদের আদি নিবাস ছিল ভারতে, এখান থেকে বিশ্বে বিভিন্ন প্রান্তে তাদের অভিপ্রয়াণ ঘটে।
সাদৃশ্য
সম্প্রতি একদল পণ্ডিত আর্যদের আদি বাসভূমি হিসাবে অধুনালুপ্ত সরস্বতী নদীর উপত্যকাকে চিহ্নিত করেছেন। অতএব আর্য সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল সিন্ধু সভ্যতার পূর্বে। এর সমর্থনে দুটি যুক্তি দেখানো হয়।
- প্রথমত ঋকবেদ রচিত হয়েছিল খ্রীঃ পূঃ ৫০০০ অব্দে।
- দ্বিতীয়ত, সিন্ধু সভ্যতার মানুষ বৈদিক সভ্যতার সামাজিক রীতিনীতি ও পোশাক-পরিচ্ছদ অনুকরণ করেছিল।
বৈসাদৃশ্য
অধিকাংশ ঐতিহাসিক উপরোক্ত মতবাদ মানেন না। তাঁরা মনে করেন সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও প্রথমটি দ্বিতীয়টির পূর্ববর্তী। এই অভিমতের সমর্থনে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি দেখানো হয়।
ভিন্ন কালসীমা
ঋকবেদের রচনাকাল খ্রীঃ পূঃ আনুমানিক ১৫০০ অব্দ অথবা তার পরে কিন্তু বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে সিন্ধু সভ্যতার কালসীম খ্রীঃ পূঃ ২৩৫০ থেকে খ্রীঃ পূঃ ১৭৫০ অব্দ পর্যন্ত। অতএব কালানুক্রম অনুসারে সিং সভ্যতা অবশ্যই বৈদিক সভ্যতার পূর্ববর্তী।
সভ্যতার প্রকৃতি ভিন্ন
বড় ইমারত, স্নানাগার, শস্যাগার, সুপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও জলনিকাশী ব্যবস্থার আবিষ্কার প্রমাণ করে যে সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রধানত নগরকেন্দ্রিক। অপরদিকে বৈদিক সভ্যতার চরিত্র ছিল মূলত গ্রামীণ। কৃষিকার্য ও পশুপালন ছিল আর্যদের প্রধান জীবিকা। অতএব চরিত্রের দিক থেকে উভয় সভ্যতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল।
ঘোড়ার উপস্থিতি
সিন্ধু সভ্যতার একেবারে ওপরের স্তরে কোন কোন স্থানে ঘোড়ার চিহ্ন আমার পাওয়া গেলেও সেখানে ঘোড়ায় বহুল প্রচলনের কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু আর্যদের কাছে ঘোড়া ছিল অপরিহার্য। এ থেকে মনে হয় খ্রীঃ পূঃ ১৫০০ অব্দে আর্যদের ভারতে আগমনের পূর্বে ঘোড়ার ব্যবহার খুব সীমিত ছিল।
পূজা পদ্ধতির ভিন্নতা
সিন্ধুসভ্যতার মানুষ গাছপালা, জীবজন্তু ও বিশেষ করে মাতৃদেবীর আরাধনা =করত। শিব-সদৃশ দেবতার অস্তিত্ব ও লিঙ্গ পূজার প্রচলন ছিল। বৈদিক সভ্যতায় এই ■ ধরনের পূজাপাঠের প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর্যদেবতারা প্রধানত পুরুষ ছিলেন। বৈদিক ৪ পূজার্চনায় স্তোত্রপাঠ ও যাগযজ্ঞের প্রাধান্য ছিল।
ধাতু ব্যবহারের ভিন্নতা
সিন্ধু সভ্যতা ছিল তাম্রপ্রস্তর যুগের অন্তর্গত। সেখানে তামা দিয়ে অস্ত্র ও মূর্তি নির্মিত হত। লোহার প্রচলন ছিল না। কিন্তু বৈদিক সভ্যতায় লোহার বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়।
লিপি
সিন্ধু সভ্যতায় লিপির বহুল ব্যবহার ছিল। সীলমোহরগুলির ওপর উৎকীর্ণ লিপি একথা প্রমাণ করে কিন্তু বৈদিক সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে শ্রুতি ও স্মৃতিকে নির্ভর করে। লিপির প্রচলন হয় দীর্ঘকাল পর।
মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি
সিন্ধু সভ্যতায় মৃতকে সমাধিস্থ করা হত। উৎখননের ফলে অনেক সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু বৈদিক আর্যরা শবদাহ করত।
মূল্যায়ন
অতএব, সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে পার্থক্যগুলি এত মৌলিক যে উভয় সভ্যতার স্রষ্টা একই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অথবা সিন্ধু সভ্যতা বৈদিকোত্তর সভ্যতা, এ তত্ত্বগুলি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। এই দাবি যাঁরা করেন তাঁরা এর সমর্থনে কিছু সাহিত্যগত সাক্ষ্য উপস্থাপিত করেন যার কোন প্রত্নতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা বরং দাবি করেন যে আর্য আক্রমণের ফলেই সিন্ধু সভ্যতার অবসান হয়।
সিন্ধু সভ্যতা থেকে অন্যান্য প্রশ্ন