সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা ও বিস্তৃতি : প্রাক বৈদিক সভ্যতা সিন্ধি বা হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল ও বিস্তৃতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নোট এখানে দেওয়া হলো।
সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা ও বিস্তৃতি লেখ
ভূমিকা
১৯২১-১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে পাঞ্জাবে হরপ্পা ও নিম্ন-সিন্ধু উপত্যকায় মহেঞ্জোদড়ো নগরীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চার ধারাটিকে নতুন পথে প্রবাহিত করেছে। বৈদিক সাহিত্যে যে সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র পাওয়া যায় এতদিন তাকেই ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীনতম পর্ব মনে করা হত। এই আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে প্রাক্-বৈদিক যুগেও ভারতে এক উন্নতমানের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এই সভ্যতা পণ্ডিত মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সিন্ধু সভ্যতা নাকি হরপ্পা সভ্যতা
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব পর্যবেক্ষণের তৎকালীন মহানির্দেশক জন মার্শালের নেতৃত্বে দয়ারাম সাহানী ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই খননকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৪৬ খ্রী.-এ মহানির্দেশক মর্টিমার হুইলারের নেতৃত্বে পুনরায় উৎখনন করে এই দুই প্রত্নক্ষেত্রে ও সংলগ্ন অঞ্চলে প্রাচীন সভ্যতার বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এর অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। এই অঞ্চলগুলি সিন্ধু উপত্যকা থেকে বহু দূরবর্তী হওয়ায় মনে হয় যে সভ্যতাটি শুধু সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
সেই কারণে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ একে প্রথমে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ আখ্যা দিলেও এখন ‘হরপ্পা সভ্যতা’ শব্দটিই বেশি পছন্দ করেন। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুগুলির সঙ্গে হরপ্পায় প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির সাদৃশ্য বেশি। সর্বোপরি, প্রাপ্ত সীলমোহরগুলির সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে না পারলেও উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আলেকজান্ডার কানিংহামই সর্বপ্রথম সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীনত্ব ও সময়সীমা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে এই সভ্যতা যে মিশরীয় ও মেসোপটেমিয়ার মত নদীমাতৃক সভ্যতার সমসাময়িক ও সমগোত্রীয়, এ বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত।
সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা বা সময়কাল
সিন্ধু সভ্যতার গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করার পথে প্রধান অন্তরায় লিখিত তথ্যের অভাব। সেখানে যে লিপি ব্যবহৃত হত তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাপ্ত সীলমোহরগুলি থেকে। কিন্তু সীলমোহরে উৎকীর্ণ লিপির সঠিক পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব না হওয়ায় সেখানে কি বলা হয়েছে তা জানার কোন উপায় নেই। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন যেহেতু বহু পরিমাণে পাওয়া গেছে, বিশেষ করে মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পায়, তার দ্বারা এই সভ্যতার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অনেকটা অনুমান করা সম্ভব। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাপ্ত পাথরের আদিম হাতিয়ারের ভিত্তিতে ভারতের প্রাচীনতম কালের ইতিহাসের একটি অস্পষ্ট কাঠামো দাঁড় করানো যায়।
মোটামুটি প্রাচীন প্রস্তর যুগ (সময়কাল খ্রী. পূ. আনুমানিক ৪০০০০০ থেকে ২০০০০০ অব্দ) থেকে আমরা কিছুটা ধারাবাহিক তথ্য পাই। এর পর ক্রমশ আসে মধ্য প্রস্তর যুগ (খ্রী. পূ. আনুমানিক ১০০০০ থেকে ৬০০০ অব্দ), নব্য প্রস্তর যুগ (ভারতে এর সময়কাল খ্রী. পূ. আনুমানিক ৭০০০ থেকে ২৫০০ অব্দ) ও তাম্র প্রস্তর যুগ (ভারতে খ্রী. পূ. তিন সহস্রাব্দ থেকে খ্রী. পূ. অষ্টম শতাব্দী)। শেষোক্ত যুগের মানুষ কৃষিকার্য জানত, অনেক জন্তুকে গৃহপালিত করে তোলে, একটি আদিম সমাজ ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল।
তারা তামার ব্যবহার জানলেও ব্রোঞ্জ আবিষ্কার করতে পারেনি যা ক্রীট, মিশর, মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধু সভ্যতার বিকাশের পথ সুগম করে। বস্তুত, দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা দেখিয়েছেন তাম্র-প্রস্তর যুগের কিছুটা প্রাক্-সিন্ধু যুগের, কিছুটা সিন্ধু সভ্যতার সমকালীন, বাকিটা সিন্ধু সভ্যতা-উত্তর যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। অধিকাংশ প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা খ্রী. পূ. আনুমানিক ২৩৫০ থেকে ১৭৫০ অব্দ পর্যন্ত। অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এ তথ্য সমর্থিত হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি
সিন্ধু সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্র হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়ো, একে অপরের থেকে ৬৪০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এই দূরত্ব বরাবর সিন্ধুনদের উভয় তীরবর্তী অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে আরও ব্যাপক খননকার্য ও অনুসন্ধানের ফলে জানা গেছে ঐ সভ্যতা দুই নগর সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর অন্যান্য অঞ্চল ছাড়াও বালুচিস্তান, গুজরাত, রাজস্থান ও পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের কোন কোন স্থানে। উত্তরে জম্মু থেকে দক্ষিণে নর্মদার মোহনা, পশ্চিমে বালুচিস্তানের মাকরান উপকূল থেকে উত্তর ভারতে মীরাট পর্যন্ত এলাকায় সিন্ধু সভ্যতা বিস্তৃত ছিল।
সিন্ধু সভ্যতার নির্দশন পাওয়া গেছে প্রায় আড়াইশো স্থানে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়ো ছাড়া আরও চারটি স্থানকে নগরের মর্যাদা দেওয়া যায়। এগুলি হল সিন্ধুপ্রদেশে চানহুদড়ো, গুজরাতে লোথাল, উত্তর রাজস্থানে কালিবঙ্গান ও হরিয়ানায় বনওয়ালি। কালিবঙ্গান ও বনওয়ালিতে সিন্ধু ও প্রাক্-সিন্ধু উভয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যই লক্ষ করা গেছে। সিন্ধু সভ্যতার সমৃদ্ধ পর্বটির নির্দশন এই ছটি নগরেই পাওয়া গেছে। সুতকাজেন্দোর ও সুর্কোতাদার মত উপকূলবর্তী অঞ্চলেও সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্বের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। গুজরাত উপদ্বীপের কাথিয়াওয়াড়ে অবস্থিত রঙ্গপুর ও রোজদি পরবর্তী সিন্ধু সভ্যতারও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এইভাবে সিন্ধু সভ্যতার ভৌগোলিক পরিসীমার যে পরিচয় পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে রামশরণ শর্মা মন্তব্য করেছেন খ্রী. পূ. তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দে বিশ্বের অন্য কোন সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতার চেয়ে বড় ছিল না।